লটকন ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন
লটকন ফলটি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠেছে সবার কাছে।রসালো এই লটকন ফলটি মূলত বর্ষাকালীন ফল।টক মিষ্টি স্বাদের এই লটকন ফলটি খেতে অনেকেই ভীষণ পছন্দ করে।লটকন ফলটি যেমন সুস্বাদু ঠিক তেমনি এর উপকারিতা ও অনেক রয়েছ।আজকে আমরা লটকন ফলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে নিব ।
লটকন ফলটি পুষ্টিগুন ও ওষুধি গুনেও ভরপুর একটি ফল ।লটকন ফলটি মৌসুমী ফল হওয়ার কারণে শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী ।আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সব সময় মৌসুমীর ফল রাখার চেষ্টা করতে হবে এতে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে আর মৌসুমী ফলের মধ্যে রয়েছে এই ওষুধে ভরপুর লটকন ফলটি ।
ভূমিকা
লটকন ফলটির দারুন স্বাদের একটি ফল ।এই ফলটি কাঁচা অবস্থায় সবুজ বর্ণের এবং পাকলে হলুদ রং ধারণ করে ।লটকন ফলটির আকারে ছোট ও গোলাকার হয়ে থাকে ।এই ফলটি ছোট হতে পারে কিন্তু এর উপকারিতা অনেক ।লটকন ফলটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার বুনো ফল হিসেবে পরিচিত।বর্তমানে লটকন ফলটি ভারত,বাংলাদেশ ,মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ,থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়ার কারণে ফলটি বেশ পরিচিত লাভ করেছে।
এক সময় বাংলাদেশের লটকন ফলটি অপ্রচলিত ফলের তালিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু এই ফলটি বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে পরিচিত হয়েছে ।প্রথম থেকে বাংলাদেশের নরসিংদী জেলাতে একমাত্র লটকন চাষাবাদ হত। কিন্তু বর্তমানে সিলেট, নেত্রকোনা ,ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ,কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লটকন ফলে চাষাবাদ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
লটকনের ইংরেজি নাম
লটকন ফলের বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চল ভেদে অনেকগুলো নাম রয়েছে আবার লটকন ফলে সুন্দর ইংরেজি নাম রয়েছে সেটা হল বার্মিজ গ্রেপ(Burmese Grape)এ লটকন ফলটির আবার বৈজ্ঞানিক নামও রয়েছে এর বৈজ্ঞানিক নামটি হল BACCAUREA MOTLEYANA,BACCAUREA SAPIDA
তবে বাংলাদেশে লটকন ফল টিকে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন বগি, লটকা ,বুবি, লটকাউ,হাড়ফাটা,রামবাই, রাম্বি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। আবার এটিকে থাইল্যান্ডের ভাষায় মাফাই ফার্ম হারান বলা হয়ে থাকে ।
লটকনে কি কি ভিটামিন আছে
লটকন এমন একটি উপকারী ফল যাতে রয়েছে অনেক ধরনের ভিটামিন। তার মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন বি ,ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি ২ এই ভিটামিনের পরিমাণ গুলো যথাক্রমে 10.04 মিলিগ্রাম এবং ০.২০ মিলিগ্রাম। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনের ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্রোমিয়াম রয়েছে।
একটি পরিপক্ক লটকনের শাস এ রয়েছে খনিজ উপাদানের পরিমাণ ০.৯ গ্রাম এবং লৌহ ০.৩ গ্রাম ।এছাড়াও লটকন ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। অতিমাত্রায় ভিটামিন সি থাকায় লটকনের মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি লটকন খেলে মানুষের শরীরে প্রতিদিনের যে ভিটামিন সি এর চাহিদা থাকে তা পূরণ হয়ে যাবে।
লটকন খেলে কি ওজন বাড়ে
লটকন ফল খেলে ওজন বাড়ে না বরং দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে। যারা অনেক মোটা বা যাদের অনেক মেদ রয়েছে ।তারা লটকন ফলটি নির্দ্বিধায় খেতে পারে। লটকনে যে ফ্ল্যাট ও কার্বোহাইড্রেট পরিমানটি খুবই সীমিত রয়েছে। এ কারণে শরীরের মেদ কমাতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। যারা অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চিন্তিত তাদের জন্য এই লটকন ফলটি বেশ উপকারী ।
লটকন ফলের উপকারিতা
লটকন ফলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ অনেক। নিচে এসব পুষ্টিগুণ উপকারিতা তুলে ধরা হলো ঃ
বিভিন্ন ধরনের শারীরিক দুর্বলতা দূর করে ।নিয়মিত লটকন ফল খেলে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কারণ লটকন ফলটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল।
লটকন ফলটি ক্লোন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।কারণে এতে রয়েছে ভিটামিন সি ,ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম যা কলন ক্যানসার ঝুঁকি কমায় বলে নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা।লটকন ফলের বিচি গনেরিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ডায়রিয়া দূর করতে লটকন ফলের পাতার গুড়া কার্যকরী।লটকন ফলে রয়েছে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যা আমাদের দাঁত ও হাড়ের জন্য অনেক উপকারী। নিয়মিত লটকন ফল খেলে দাঁত ও হাড় মজবুত হয়।
লটকন ফলের অপকারিতা
লটকন ফলের অপকারিতা তেমন একটা নেই। তবে অতিরিক্ত বেশি পরিমাণ লটকন ফলটি খেলে কিছু অপকারিতা দিক দেখা দেয় যেমনএকসাথে অতিরিক্ত লটকন ফল খেলে ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে। তাই ক্ষুধামান্দার জন্য অতিরিক্ত লটকন ফল খাওয়া যাবেনা।
লটকন ফল খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে এবং লটকন ফলে ভিটামিন সি থাকায় অতিরিক্ত খেলে এসিডিটি দেখা দিতে পারে ।তবে এই লটকন ফলটির অপকারিতা থেকে উপকারিতার দিকটাই বেশি।
গর্ভাবস্থায় লটকন ফল খাওয়ার উপকারিতা
একজন গর্ভবতী মহিলার অনেক খাদ্য শক্তির ও বিভিন্ন রকম পুষ্টির প্রয়োজন হয় ।তাই গর্ভাবস্থায় এগুলো চাহিদা পূরণ করতে হয় ।গর্ভাবস্থায় লটকন খেলে অনেক রকম রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং প্রসবকালের সকলবিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন…গর্ভাবস্থায় বেশি লটকন না খেলেই ভাল হয় ।
লটকন ফল খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে
লটকন ফলে থাকা অ্যামাইনো এসিড ও এনজাইম দেহকে মজবুত করে গঠন করে। এ সমস্ত উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এজন্য দেহের যাবতীয় কোষেরোধ পূরণ করে ফলে মানব দেহের কোষ্ঠগুলো সম্পন্ন সুস্থ থাকে ।
আর লটকনে থাকা সব ধরনের ভিটামিন আইরন, শর্করা খনিজ যে ভরপুর থাকার কারণে রক্তের শর্করা বা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে ।ফলে ডায়বেটিস রোগীরা লটকন ফল খেলে কোন সমস্যা হবে না ।
লটকন ফলের সিজন
লটকন ফল হওয়া বা পাকার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে শীতের শেষের দিকে অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষের দিকে লটকন এর ফুল ধরা শুরু হয় এবং আষাঢ় মাসে শেষের দিকে বা শ্রাবণ মাসে শুরুর দিকে ।এই ফল পাকতে শুরু করে। আর এটি বর্ষাকালের ফল ।
লটকন ফলের জাত সমূহ
লটকন ফলের ভিন্ন ভিন্ন জাত রয়েছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম উন্নত কয়েকটি জাত হলো
FTIP-BAU লটকনে ১ এই জাতটিকে আবার গৌরীপুরী লটকন বলা হয়।এ ধরনের লটকন প্রতি হেক্টর জমির তে ৮ থেকে ১০ টন উৎপাদিত হয় ।
এ জাতের লটকন চাষের তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না। এতে লটকনের সুন্দর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি নিয়মিত আগাম জাত লটকনের এই ফলের ওজন ২০ থেকে ৩৫ গ্রাম হয়ে থাকে। আর এটি বামন জাত হওয়ার কারণে ফলগুলো গুচ্ছ ভাবে খুব বেশি আকারে গাছে ধরে থাকে ।
বারি লটকন ১ এ চারটি বাংলাদেশের চাষের জন্য ২০০৮ অনূদিত হয় ।এটাকে মাঝারি জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।কারণ এটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে পাকতে শুরু করে এবং গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা হয় প্রায় ৩৩৪টি ।
আবার এটি একটি নিয়মিত উচ্চ ফলনশীল জাত হিসেবে স্বীকৃত ।প্রতিটি লটকনের এই জাতের চারা হতে চার থেকে পাঁচটি করে নরম বিছি।স্বাদ টক মিষ্টি ধরনের লটকন হয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সর্বত্র চাষের উপযোগী।
লটকন ফলের বিচি খেলে কি হয়
লটকন ফলের বিচি অনেক উপকারী রোগের প্রতিশেধক হিসাবে কাজ করে। পেটের অসুখ ভালো করে গনোরিয়ার মত রোগ ভালো করে এই লটকন ফলের বিচি ।
লটকন ফলে পাতা খেলে কি হয়
লটকন ফলের গাছের ডাল, পাতা ,শিকড় সবকিছুতেই ওষুধি গুনাগুন রয়েছে ।লটকন গাছের কাঁচা পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে খেলে ডায়রিয়া, আমাশয় ও মানসিক চাপ কমে যায় ।এছাড়া লটকন গাছের শিকড় ,পাতা খেলে পেটে নানা ধরনের রোগ ও সমস্যা দূর হয়। আবার লটকন গাছের ছাল ও পাতা চর্মরোগ দূর করতে সাহায্য করে ।
লটকন ফল শক্তিতে কাঁঠালের দ্বিগুণ
আল্লাহর সৃষ্টি প্রতিটি ফলেরই ঔষধি গুনাগুন ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে ।আল্লাহ তাআলা প্রতিটি ফলে মানব দেহের জন্য এক একটি অমূল্য প্রতিশোধ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন ।সে ক্ষেত্রে লটকন ফলটি আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালের চেয়ে দ্বিগুণ পুষ্টিগুণ রয়েছে ।
লটকন ফল খাওয়ার সতর্কতা
গর্ভাবস্থায় লটকন ফলের বীজ খাওয়া সাধারণত এড়িয়ে চলতে হবে।লটকন ফল খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে ।যাতে কোন রাসায়নিক জীবাণু না থাকে ।লটকন ফল খেলে যদি এলার্জি সমস্যা হয়। তাহলে লটকন ফল না খাওয়াই ভালো ।অতিরিক্ত লটকন খাওয়ার ক্ষেত্রে অম্লতা সৃষ্টি হয় তাই অতিরিক্ত লটকন ফল না খাওয়াটাই ভালো ।
লটকন ফল খাওয়ার নিয়ম
প্রথমে লটকন ফলগুলো পাকা দেখে বেছে নিব। এরপর ফলগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে।তারপর খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের অংশটি খেতে হবে ।তবে ভিতরে যে বিচি রয়েছে তা ফেলে দিতে হবে ।
লটকন গাছ কত বছর পর ফল দেয়
লটকন গাছ রোপনের তিন থেকে চার বছর পর ফল ধরতে শুরু করে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে লটকন গাছে ফুল আসে ।তাই গাছে ফুল আসার আগে মার্চ মাসের কাছে গাছের গোড়ায় মাটি সামান্য কুপিয়ে তাতে প্রয়োজন মত সার প্রয়োগ করে সেচ দিতে হয় ।
লটকন ফলের দাম
লটকন ফলের দাম একটু বেশি কারণ লটকন ফল পুরো বাংলাদেশে অনেক বেশি চাষ হয় না। তুলনামূলকভাবে কম চাষ হয়ে থাকে ।তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারে দরদামটি কম বেশি হতে পারে প্রতি কেজি লটকনের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে থাকে এবং রাজধানীতে প্রতি কেজিতে ১০০ থেকে ১১০ টাকা
পুরুষ লটকন গাছ চেনার উপায়
অনেকেই শখের বসে লটকন গাছ রোপন করে থাকে কিন্তু রোপনের বছর তিনেক পর দেখা যায় গাছে কোন ফল হচ্ছে না এর কারণ হলো গাছটি পুরুষ লটকন গাছ। যার কারণে ফল ধরে না। তাই লটকন গাছ রোপন করার আগে অবশ্যই গাছটি পুরুষ নাকি স্ত্রী সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
পুরুষ লটকন গাছ চেনার উপায় হল ।লটকন গাছের যখন ফুল আসে তখন ফুলগুলো হলুদ রঙের হয় এবং কয়েক দিনের ভেতর ফুল গুলো ঝরতে শুরু করে ।কিন্তু স্ত্রী লটকন গাছের ফুল একটু বড় হয় এবং বড় বড় গুটি আকারে দেখা দেয়। গাছ চেনার ক্ষেত্রে এ দুটো উপায় দেখে গাছ কিনতে হবে ।
লটকন ফল কতদিন পর্যন্ত ভালো থাকে
লটকন ফল আমরা সাধারণত হালকা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পেড়ে থাকি ।এই ফলটির অনেক রসালো ফল ।তাই ফলটি সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত ভালো থাকে কিন্তু আমরা যদি ফ্রিজে সংরক্ষণ করি তাহলে কিছুদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। লটকন ফল সাধারণত ঘরের ভেতরে যদি রাখা হয় তাহলে দুই থেকে তিন দিনের বেশি রাখা যায় না ।
লটকন ফলটিতে একটু আঘাত লাগলেই এর পচন প্রক্রিয়া শুরু হয় ।তাই এটি বেশি দিন পর্যন্ত প্রক্রিয়াজাত করে রাখা সম্ভব হয় না ।
লেখক এর মন্তব্য
লটকন ফলটি বেশ উপকারী একটি ফল এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর ।লটকন ফলের ঘরোয়া চিকিৎসা বেশ উপকারী ।যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারসাধন করে।বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলার জন্য লটকন ফলটি দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় রাখা প্রয়োজন ।এই আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনাদের কোন উপকারে আসে বা ভালো লাগে তাহলে আপনাদের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন ধন্যবাদ ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url